আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির দৃষ্টি ও ভাবনায় সাংস্কৃতিক নকশা ও মডেলসমূহ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির সাংস্কৃতিক চিন্তাজগতে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—তিনি ইতিহাস-সমলয় ইসলামী আদর্শ থেকে শুরু করে আধুনিক ডিজিটাল সভ্যতায় উদিত সমস্ত সাংস্কৃতিক মডেলকে গভীরভাবে বিবেচনায় আনেন এবং এগুলোকে সমাজপরিবর্তনের বিশ্লেষণাত্মক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির সাংস্কৃতিক চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে—তিনি সংস্কৃতির মডেলসমূহকে বিস্তৃত পরিমণ্ডলে পর্যবেক্ষণ করেন; হোক তা ইতিহাস ও ইসলামী সাধনাশীলতায় প্রোথিত মডেল, অথবা আধুনিক যুগে বিশেষত ভার্চুয়াল জগতে নবোদ্ভূত চিন্তার ধারাবাহিকতা।
মরিয়ম মরতেজাভি লিখছেন—সংস্কৃতির জ্ঞানতত্ত্ব (Cognitive Science of Culture) আধুনিক মানবসমাজে এক বিস্তৃত আলোচনার ক্ষেত্র। যদিও জ্ঞানবিজ্ঞান বহু সামাজিক পরিসরে প্রবেশ করেছে, তবু সংস্কৃতির সঙ্গে এর সূক্ষ্ম সম্পর্কের আলোচনা তুলনামূলকভাবে বিরল।
সাংস্কৃতিক সংকট নিরসনে প্রয়োজন—সমাজের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চালিকাশক্তিকে বোঝা এবং তা সংস্কৃতির সঙ্গে কীভাবে যুক্ত—তার নিবিড় পর্যবেক্ষণ। এ ক্ষেত্রে ইসলামী ভাবধারায় নিহিত সাংস্কৃতিক মডেলের অনুসন্ধান সমাজরূপান্তরের এক কার্যকর পথরেখা হতে পারে।
সাংস্কৃতিক মডেলের উৎসধারা
এ ধারণার সূচনা দেখা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে—যেখানে মানব আচরণ বিশ্লেষণের প্রয়াস থেকে নানা তত্ত্বের জন্ম। প্রথমদিকের গবেষকরা এমন রোবট তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, যা মানুষের ন্যায় কার্যসম্পাদনে সক্ষম। কিন্তু তারা বুঝলেন—মানবসমাজের সূক্ষ্ম আচরণবোধ রোবট আত্মস্থ করতে পারে না।
মানুষকে আপ্যায়ন করার মতো সরল আচরণও রোবটের পক্ষে অসম্ভব, যদি না তার জন্য পূর্বনির্দিষ্ট আচরণ–নকশা স্থাপন করা হয়। পরে দেখা গেল—এসব আচরণ–নমুনা ব্যক্তিগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ভিত্তিতে নির্মিত।
ফলে একই কাজ বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্নভাবে সম্পাদিত হয়—যেমন ইরানের শোকানুষ্ঠান এবং চীনের শোকানুষ্ঠানের স্বরূপে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, কারণ প্রতিটি জাতিই তার নিজস্ব আচরণ–নিয়ম বা সাংস্কৃতিক মডেল বহন করে।
রূপান্তরের উপায় হিসেবে সাংস্কৃতিক মডেল
সাংস্কৃতিক গবেষণায় এসব মডেলকে সমাজের পরিবর্তন ও সঙ্কট–ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ধরা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আজ নতুন সাংস্কৃতিক মডেল তৈরির প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছে।
সংস্কৃতির দর্শন: ভাবনা ও প্রয়োগ
সংস্কৃতির দর্শন দ্বিমুখী— একদিকে বিমূর্ত ও মানসিক বিশ্লেষণ, অন্যদিকে বাস্তব–অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংস্কৃতির প্রয়োগ এবং মডেলের বিচার। বর্তমান যুগে দ্বিতীয়টির গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রবল।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির সাংস্কৃতিক চিন্তা: মডেলসমূহের প্রয়োগ
তাঁর সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণে মডেলসমূহ একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান অধিকার করে। তিনি ইসলামী ইতিহাসের রূপক ও দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে সমকালীন সামাজিক–রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন।
যেমন— মসজিদে জিরার” ধারণাকে তিনি সামাজিক বিশ্লেষণে এক ধরনের সাংস্কৃতিক মডেল হিসেবে প্রয়োগ করেছেন। আবার “রাজনৈতিক بصیرت” বাছিরাত ধারণাটিও সমাজের সচেতনতা ব্যাখ্যায় তাঁর ব্যবহৃত এক সাংস্কৃতিক মডেল।
রূপক মডেল ও সাংস্কৃতিক অ্যালগরিদম
রূপক মডেল সংস্কৃতি বোঝার এক বলিষ্ঠ পদ্ধতি। “সাংস্কৃতিক আগ্রাসন” বা “ফিতনা”—এ ধরনের রূপক সমাজবাস্তবতার অর্থবহনকে নতুন মাত্রা দেয়।
সাংস্কৃতিক মডেল অনেক সময় অ্যালগরিদমের মতো কাজ করে—যেগুলো সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজের আচরণ ও সাংস্কৃতিক প্রবাহকে নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত করে।
সাংস্কৃতিক রূপান্তরের তিন মহাধাপ
১. কুরআন ও আহলে বায়তের জীবনে নিহিত সাংস্কৃতিক মডেল আহরণ।
২. সমাজে বিদ্যমান মডেলসমূহ শনাক্তকরণ।
৩. এসব মডেল পরিবর্তনের উপযোগী অ্যালগরিদম উদ্ভাবন ও প্রয়োগ।
এই তিন ধাপ অনুসরণ করলে সাংস্কৃতিক সঙ্কট উত্তরণ ও সমাজের সামগ্রিক রূপান্তরে কার্যকর পথ উন্মোচিত হয়।



