জীবনযাপনকুরআন শিক্ষাধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

আমরা পরকালের পরিণতি সম্পর্কে অবগত, তবুও গাফেলদের মতো জীবনযাপন করি

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: পরকাল — এক অনন্ত জীবন, যেখানে অশেষ নিয়ামত ও আনন্দের কোনো শেষ নেই; এক এমন জীবন যেখানে গাছ শুকায় না, সুখ ফুরোয় না, সঙ্গী বার্ধক্যে পৌঁছায় না। তবুও মানুষ, এমনকি জ্ঞানী ও ধর্মপালনকারী ব্যক্তিও, প্রায়ই এই চিরস্থায়ী জীবনের বিনিময়ে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার আনন্দ বেছে নেয়।

কুরআন মজিদে স্পষ্ট বলা হয়েছে: “যারা দুনিয়া ও এর সাজসজ্জা চায়, তাদের জন্য জাহান্নামই পরিণাম; আর যারা আখিরাত চায় ও তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে, তাদের পরিশ্রম আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য।”

প্রতিটি সকালেই আমাদের ভাবা উচিত — আমরা কার দলে? দুনিয়ার অনুগামী, না আখিরাতের পথিক?

জীবনের প্রকৃত অর্থ থেকে গাফেলতা

আল্লামা মিসবাহ ইয়াযদি (রহ.) তাঁর এক নৈতিক পাঠে বলেন, মানুষের সাধারণত মনেই আসে না যে চিরন্তন জীবন সত্যিই বিদ্যমান হতে পারে। এই চিন্তা তাদের মধ্যে জাগ্রত হয় কেবল তখনই, যখন নবী-রাসুল ও আলেমরা তাদের সামনে যুক্তি ও প্রমাণ সহকারে তুলে ধরেন যে — আখিরাত বাস্তব সত্য, এটি কল্পনা নয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো — যখন আমরা বিশ্বাস করে নিলাম যে কুরআনের প্রতিটি বাণী সত্য, জানলাম জাহান্নামের শাস্তিও সত্য, তবুও আমাদের জীবনে এর প্রতিফলন কোথায়?

জানার পরও অবহেলা— এক বেদনাদায়ক বাস্তবতা

আল্লামা বলেন, “সাধারণ মানুষ যদি ভুল করে, তাদের ভুল অনেকটা ক্ষমার যোগ্য, কারণ তারা জানে না। কিন্তু আমরা — যারা বারবার কুরআন পড়েছি, বহুবার তাফসির শিখিয়েছি, ধর্ম নিয়ে লিখেছি — আমরাও যদি সেই অজ্ঞদের মতো আচরণ করি, তবে তা আরও করুণ।”

আমি জানি, আমার জীবনের এক ঘণ্টা সময়ে আমি চাইলে চিরস্থায়ী সওয়াব অর্জন করতে পারতাম।কিন্তু আমি সেই সময়কে ব্যয় করলাম কিসে? একটি সুস্বাদু খাবারে? কয়েক মিনিটের ক্ষণস্থায়ী আনন্দে?

এ কি শিশুসুলভ আচরণ নয়? না, বরং তার চেয়েও খারাপ।

কারণ এক ও দুই হাজারের মধ্যে একটি অনুপাত আছে; কিন্তু দুনিয়ার ক্ষণিক আনন্দ ও আখিরাতের সীমাহীন আনন্দের মধ্যে কোনো তুলনাই নেই—  এ যেন অসীমের সঙ্গে শূন্যের তুলনা!

পবিত্র কুরআনের সতর্কবার্তা

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا، الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا”

— “বল, আমি কি তোমাদের জানাব সেই লোকদের কথা, যারা তাদের কর্মে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত? তারা দুনিয়ার জীবনে চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভেবেছে যে তারা সৎকাজ করছে।” (সূরা কাহফ ১৮:১০৩–১০৪)

আমরা ভাবি, আমরা নবীদের মতো পথ অনুসরণ করছি, কিন্তু আমাদের হৃদয় অনেক সময় কাফেরদের মতোই — তারা দুনিয়াকে ভালোবাসে, আখিরাতকে বিসর্জন দেয়; আর আমরা? আমরাও কি তা-ই করছি না?

আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবন বনাম দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী মোহ

আল্লামা বলেন, “হয়তো আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, কিন্তু বাস্তবতা হলো— আমরা প্রায়ই মুহূর্তের আনন্দের বিনিময়ে চিরন্তন পরকাল বিক্রি করি। কখনও তা হয় কল্পনাজাত সুখ, কখনও কোনো পদবি বা প্রশংসার লোভে।”

কুরআনে মানবজাতিকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে —

১️. দুনিয়ার অনুগামী:

“مَن كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَن نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَّدْحُورًا”

— “যে ব্যক্তি ত্বরিত (দুনিয়ার) জীবন চায়, আমরা যাকে চাই তাকে তা দেই; তারপর তার পরিণতি হয় জাহান্নাম।” (সূরা ইসরা ১৭:১৮)

২️. আখিরাতপ্রত্যাশী:

“وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَٰئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُو”

— “আর যে আখিরাত চায় এবং সে অনুযায়ী চেষ্টা করে, আর সে মুমিন— তার পরিশ্রম আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য।” (সূরা ইসরা ১৭:১৯)

প্রতিদিনের আত্মসমালোচনার আহ্বান

প্রতিদিন সকালে আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত — আজ আমার প্রথম চিন্তা কী? দুনিয়ার সাজসজ্জা, নাকি আখিরাতের মুক্তি?

কারণ ঈমানদার ও অবিশ্বাসী দুজনই দুনিয়ায় কাজ করে, খায়, উপার্জন করে, সংসার গড়ে — তাদের বাহ্যিক জীবন আলাদা নয়। কিন্তু পার্থক্য ঘটে শেষ পরিণামে —

وَفِّي إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ، أُولَٰئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ

— “আমরা দুনিয়ায় তাদের কর্মের প্রতিদান দিই, কিন্তু আখিরাতে তাদের জন্য নেই কিছুই, কেবল আগুন।” (সূরা হুদ ১১:১৫–১৬)

সুতরাং, যারা আখিরাতের আশায় কাজ করে, কেবল তারাই সফল; আর বাকিদের সব পরিশ্রম — অবশেষে অর্থহীন।

শেষ কথা

আমরা সবাই আখিরাতের কথা জানি, কিন্তু প্রায়ই তা ভুলে গিয়ে গাফেলদের মতো জীবন যাপন করি। আল্লামা মিসবাহ ইয়াযদির এ উপদেশ যেন আমাদের প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় — “আজ আমি কার পথে? দুনিয়ার, না আখিরাতের?” কারণ এক ঘণ্টার সৎকর্ম হতে পারে চিরস্থায়ী জান্নাতের বিনিময়, আর এক মুহূর্তের গাফেলতা হতে পারে অশেষ অনুতাপের কারণ।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button