জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

আনন্দের সূত্র: কীভাবে দোয়ার মাধ্যমে জীবনের গিঁট খুলে সুখ ও প্রশান্তি অর্জন করা যায়

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: দোয়া ও আল্লাহর সঙ্গে গভীর আত্মিক সম্পর্ক জীবনের প্রশান্তি ও আনন্দ লাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়। দোয়া এমন এক আধ্যাত্মিক শক্তি যা উদ্বিগ্ন হৃদয়কে শান্ত করে, মনের অস্থিরতা দূর করে এবং জীবনের কঠিনতম গিঁটগুলো আল্লাহর কৃপায় উন্মোচিত করে। এই সম্পর্ক এমনকি জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও অন্ধকার সময়েও মানুষকে সাহস, স্থিরতা ও আশা প্রদান করে।

মাযানদারান প্রদেশের বিশিষ্ট আলেম ও গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম হোসেইন তাকিপুর তাঁর ধারাবাহিক আলোচনায় “ইসলামের দৃষ্টিতে আনন্দ ও প্রফুল্লতা অর্জনের উপায়সমূহ” শীর্ষক বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন—এই আলোচনা ধারাবাহিকভাবে আনন্দের সূত্র (فرمول شادی)” নামে প্রকাশিত হচ্ছে, যাতে আল্লাহমুখী জীবনের প্রকৃত প্রশান্তি ও আনন্দের রহস্য তুলে ধরা হয়েছে।

বিশিষ্ট আলেম ও গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম হোসেইন তাকিপুর

দোয়া: আত্মার প্রশান্তি ও আনন্দের মূল উৎস

আনন্দ ও প্রাণবন্ততা সৃষ্টির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো দোয়া করা এবং দোয়ার মানুষ হয়ে ওঠা। যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে থাকে, সে কখনো একাকিত্ব বা ভয় অনুভব করে না। কারণ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কই মানুষকে সত্যিকারের প্রশান্তি ও নিরাপত্তা দেয়। যারা দোয়ার মানুষ নয়, যারা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না, তারা মূলত আল্লাহর করুণা থেকে বঞ্চিত।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলেন: مَا يَعْبَؤُا بِكُمْ رَبِّي لَوْلَا دُعَاؤُكُمْ
তোমাদের দোয়া না থাকলে, তোমাদের প্রতি আমার প্রভু কোনো মনোযোগই দিতেন না।”
(সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ৭৭)

অর্থাৎ, যদি তোমাদের প্রার্থনা না থাকত, যদি তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কথা না  বলতে, যদি হৃদয়ের গভীরে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত না হতো — তবে তোমরা তাঁর নজর-ই-করুণা থেকে বঞ্চিত হতে।

তাই তোমরা তোমাদের অক্ষমতা, দারিদ্র্য ও নিরুপায়ত্ব আল্লাহর সামনে প্রকাশ করো; বিশেষ করে সিজদার অবস্থায়। তখনই বুঝবে, কীভাবে অন্তর প্রশান্ত হয়, কীভাবে আত্মা হালকা হয়ে যায়।

আল্লাহর বান্দারা কেন শান্ত থাকে

প্রতিরোধের শহীদ নেতা  সাইয়্যেদ  হাসান নাসরুল্লাহ (রহ.), যার জীবন শেষ করার উদ্দেশ্যে  ইসরাইল তাঁর  ওপর  ৮৩ টন বিস্ফোরক ফেলেছিল— তবু তিনি ছিলেন শান্ত, স্থির ও নির্ভীক।
তাঁর বক্তব্যে, আচরণে ও মুখভঙ্গিতে যে গভীর প্রশান্তি দেখা যায়, তা কেবল আল্লাহর স্মরণ ও দোয়ার মানুষের বৈশিষ্ট্য।

আমি সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করছি। তাঁর সঙ্গে শহীদ হওয়া অন্যান্য মহান প্রতিরোধ কমান্ডাররাও দোয়া ও আল্লাহর স্মরণে জীবন অতিবাহিত করতেন।

ইয়াহইয়া সানওয়ার: দোয়ার প্রতীক

শহীদ ইয়াহইয়া সিনাওয়ার –এর দেহে যখন তল্লাশি করা হয়, তাঁর পকেটে ইমাম হুসাইন (আ.)–এর তুরবতের তসবিহ পাওয়া যায় এর মানে, তিনি ছিলেন আত্মসমর্পিত, ছিলেন আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন। এই দৃশ্য প্রমাণ করে যে, প্রকৃত সাহসী মানুষরাও আল্লাহর সামনে বিনয়ী হন এবং স্মরণে থাকেন তাঁর।

কুরআনে যেমন বলা হয়েছে:

أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
জেনে রাখো! আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।”
(সূরা রা‘দ, আয়াত ২৮)

আল্লামা তাবাতাবাঈর (রহ.) পরামর্শ: ৬৬ বার “আল্লাহ”

একবার আমি আয়াতুল্লাহ আবেদীর মাধ্যমে আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ.)–এর একটি পরামর্শ শুনেছিলাম। কিছু বন্ধু এসে বললেন, “আপনি যে পদ্ধতির কথা বলেছিলেন, আমরা তা ঠিকভাবে পালন করেছি, আর সত্যিই আমাদের অন্তরে প্রশান্তি এসেছে।”

অনেক সময় মানুষ রাগান্বিত হয়, মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন বা অস্থির থাকে। তারা জানতে চায়—কীভাবে চেহারার প্রশান্তি ও অন্তরের স্থিরতা বজায় রাখা যায়?

আল্লামা তাবাতাবাঈ বলেছিলেন, “তোমার সমস্ত মন ও আত্মাকে একাগ্র করে ৬৬ বার বলো — الله الله الله (আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ)।”

তিনি আরও বলেন, “এটি করতে হবে পূর্ণ মনোযোগসহ, যেমন নামাজের পর বা তাহাজ্জুদের সময়, যখন অন্য কেউ উপস্থিত নেই।
টেলিভিশন দেখে বা অন্য কাজে মগ্ন থেকে এই জিকির পড়লে এর ফল পাওয়া যায় না। শুধু তখনই সত্যিকার প্রশান্তি লাভ করবে, যখন তুমি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করবে।”

এমনকি যদি কেউ এই দোয়া নিয়ে উপহাস করে, তাতে বিচলিত হয়ো না।
কারণ আল্লাহর স্মরণই প্রকৃত শান্তির উৎস।

সাইয়্যেদ  হাসান নাসরুল্লাহ ও রাহবারের (আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি) সংলাপ

সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ একবার বলেন, “আমি রাহবারের (মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি) কাছে গিয়েছিলাম। বললাম, ‘আগাজান, আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি আর (হিজবুল্লাহর) মহাসচিব থাকতে চাই না। আমি প্রতিরোধের একজন সৈনিক হয়েই থাকতে চাই। বিতর্ক, মতভেদ ও ক্লান্তি বেড়েছে।’”

রাহবার হাসলেন এবং বললেন, “সাইয়্যেদ হাসান, তুমি যে বলছো, ‘আমি বুড়ো হয়েছি’ — আমার দাড়ি তোমার চেয়ে তিনগুণ সাদা! আমি যদি ক্লান্ত না হই, তুমি কেন হবে?”

তারপর তিনি উপদেশ দিলেন: “যখনই ক্লান্ত বা হতাশ বোধ করবে, একা একটি ঘরে গিয়ে দশ বা পনেরো মিনিট আল্লাহর সঙ্গে কথা বলো — যে ভাষায় চাও: আরবি, ফারসি, ইংরেজি — যেভাবে সহজ মনে হয়। তোমার মনের কথা বলো, অভিযোগ করো, কাঁদো — তারপর দেখবে, তোমার অন্তর কেমন প্রশান্ত হয়ে যায়।”

দোয়া: আত্মার প্রশান্তির রহস্য

কখনও তুমি দোয়া কুমাইল, দোয়া নুদবা বা অন্য কোনো দোয়া পাঠ করো— তখন তোমার চোখে অশ্রু আসে, হৃদয় হালকা হয়, এবং মনে এক গভীর শান্তি নেমে আসে। তুমি হয়তো বুঝতে পারো না কেন কাঁদছো, কিন্তু পরে বুঝবে — এটি দোয়ার অলৌকিক প্রভাব। দোয়া শুধু শব্দ নয়, এটি আত্মার স্নান।

হাজ কাসেম সোলাইমানি ও দোয়ার অলৌকিক শক্তি

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, শহীদ হাজ কাসেম সোলাইমানিকে তাঁর সহযোদ্ধারা সামনের সারিতে যেতে বাধা দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন: “হাজি, আল্লাহর কসম, আপনি সামনে যাবেন না! এখানে ফ্রন্টলাইন, অত্যন্ত বিপদজনক!”

কিন্তু হাজ কাসেম তাঁদের হাত এড়িয়ে এগিয়ে যান। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়: “হাজি, আপনি কি সেই দোয়াটি পড়েছেন?”
তিনি উত্তর দেন: “হ্যাঁ, আমি পড়েছি — اللهم اجعلني في درعك الحصينة التي تجعل فيها من تريد।”

অর্থ: “হে আল্লাহ! আমাকে তোমার দৃঢ় ও নিরাপদ দুর্গে রাখো — যেখানে তুমি যাকে চাও তাকে রক্ষা করো।”

তিনি বললেন, “আয়াতুল্লাহ বাহজা (রহ.) আমাকে বলেছেন, বিপদের সময় এই দোয়া পড়তে।”

বাহজা (রহ.) আরও উপদেশ দিয়েছিলেন— যখন সন্তান বা নাতি–নাতনিদের স্কুলে পাঠাও, তখন আয়াতুল কুরসি পড়ে এই দোয়াটি পড়ো। এতে আল্লাহ তাদের সব বিপদ থেকে নিরাপদ রাখবেন।

আয়াতুল্লাহ বাহজাতের নির্দেশ: দোয়া ও আধ্যাত্মিকতা

আয়াতুল্লাহ বাহজাত বলতেন, “অনেকবার দেখা ও শোনা গেছে, যে ‘হাদিসে কিসা’ পাঠের সময় ইমাম মাহদি (আ.) নিজে উপস্থিত থেকেছেন। তাই প্রতিদিন— তোমাদের সমস্যা, রোগব্যাধি ও বিপদের সময় এই হাদিস পড়ো।”

একজন ব্যক্তি একবার এসে বললেন, “হুজুর, আমি অনেক দোয়া করেছি, কিন্তু আমার অন্তরের গিঁট খুলছে না।”

তিনি বললেন, “কোনো সমস্যা নেই। আমাকে একটি দেশলাই দাও।” লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “দেশলাই কেন?”
তিনি বললেন, “এই দেশলাইটি পানির পাশে রাখো যাতে ভিজে না যায়, তারপর জ্বালাও।
যদি আগুন না ধরে, বুঝবে স্থানটি ভেজা — অর্থাৎ ‘নম’ আছে। তেমনি তোমার হৃদয়ও যদি পাপে ভেজা থাকে, তবে দোয়ার আগুন জ্বলবে না।
তুমি আগে সেই পাপ মুছে ফেলো, তওবা করো — তারপর দেখবে, তোমার দোয়া কীভাবে ফলপ্রসূ হয়।”

লোকটি বলল, “আপনি সবসময় বলেন, যখন কিছু হয় না, তখন বুঝতে হবে কোনো গুনাহ আছে। কিন্তু আমি তা মানতে পারি না।”

তিনি হেসে বললেন, “ঠিক আছে, তাহলে আরেকটি কথা শোনো।

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— যে ব্যক্তি দোয়া করে, আল্লাহ তার জন্য তিনটি ফলাফলের একটিকে নির্ধারণ করেন:

1️. তার চাওয়া পূর্ণ করে দেন,
2️. তার জীবনের কোনো বিপদ দূর করে দেন,
3️. আর যদি কিছুই না হয়, তবে তা তাঁর আমলনামায় সঞ্চিত থাকে এবং কিয়ামতের দিন তিনি তার প্রতিদান লাভ করবেন।”

দোয়া—জীবনের সত্যিকারের আনন্দের রহস্য

দোয়া শুধুমাত্র কিছু শব্দ উচ্চারণ নয়; এটি আল্লাহর সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ, একটি আত্মিক সংলাপ, যা মানুষকে ভয় থেকে সাহসে, দুঃখ থেকে প্রশান্তিতে এবং হতাশা থেকে আশায় ফিরিয়ে আনে।

আল্লাহর সঙ্গে কথা বলো। দোয়া করো। কারণ দোয়া এমন এক আলোকরশ্মি, যা অন্ধকার হৃদয়কে আলোকিত করে, কঠিন সময়কে সহজ করে এবং জীবনের প্রতিটি গিঁট খুলে দেয় সেই মহা দয়ালু প্রভুর করুণায়।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button