আখেরি যামান:পবিত্র গ্রন্থে ভবিষ্যৎবাণী ও তাৎপর্য
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: খ্রিস্টধর্ম এবং ইহুদিধর্ম—দুটি প্রাচীন আসমানী ধর্মই একটি “শেষকাল” বা “অন্তিম যুগ”-এর স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নের রঙ, গন্ধ এবং গন্তব্য ভিন্ন। খ্রিস্টানের চোখে শেষযুগ মানে যিশু মসীহের মহিমাময় পুনরাগমন এবং পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্বের সোনালি প্রভাত। আর ইহুদির হৃদয়ে তা মাশিয়াখের আবির্ভাব—যিনি ইতিহাসের সমস্ত অশ্রু মুছে দিয়ে ন্যায় ও শান্তির এক অভূতপূর্ব যুগের সূচনা করবেন। দুই ধর্মের এই ভবিষ্যৎ-কল্পনা একই আকাশের দুই ভিন্ন নক্ষত্রের মতো—কাছাকাছি, তবু আলাদা।
প্রশ্ন জাগে—খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্মে “শেষযুগ” বা “আখেরি যামানা” কী রূপে কল্পিত? তাদের পবিত্র গ্রন্থে কি একই আলো জ্বলে, নাকি দুই ভিন্ন ছায়াপথ?
শেষযুগ খ্রিস্টধর্মের আয়নায়
খ্রিস্টান বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এক অলৌকিক প্রত্যাবর্তন—যিশু মসীহের দ্বিতীয় আগমন। পবিত্র বাইবেলে তিন শতাধিকবার এই প্রতিশ্রুতি উচ্চারিত হয়েছে; ম্যাথু, মার্ক, লুক এবং প্রকাশিত বাক্যের সম্পূর্ণ অধ্যায়সমূহ যেন একটি মাত্র আশার গান গায়।
খ্রিস্টানের দৃষ্টিতে শেষযুগ মানে অন্ধকারের শেষ রাত্রি এবং নতুন সকালের প্রথম আলো। যিশু ফিরে আসবেন মেঘের উপর আরোহণ করে, তূর্যনিনাদের মধ্যে, মহিমার আলোয়। সেদিন যুদ্ধ থামবে, অশ্রু শুকাবে, সিংহ এবং মেষশাবক একত্রে বিচরণ করবে। পাপের শৃঙ্খল ভেঙে মানবজাতি আল্লাহর রাজত্বে প্রবেশ করবে।
কিন্তু তার পূর্বে আসবে ভয়াল লক্ষণসমূহ—জাতির বিরুদ্ধে জাতি উঠবে, রাজ্যের বিরুদ্ধে রাজ্য; দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং ভূমিকম্প পৃথিবীকে কাঁপাবে। সূর্য অন্ধকার হবে, চন্দ্র রক্তিমাভা ধারণ করবে, নক্ষত্রসমূহ আকাশ থেকে খসে পড়বে। তবু এই অন্ধকারের মধ্যেই খ্রিস্টান শোনে ত্রাণকর্তার পদধ্বনি।
শেষযুগ ইহুদিধর্মের কল্পনায়
ইহুদি ধর্মগ্রন্থে “ইয়োম আদোনাই”—প্রভুর দিন—বারংবার উচ্চারিত হয়েছে ভয় এবং আশার সঙ্গে। এই দিনটি ইতিহাসের পরিসমাপ্তি নয়, বরং নতুন সৃষ্টির প্রথম দিন। তার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন মাশিয়াখ—ঈশ্বর-প্রেরিত সেই মহামানব, যিনি দাউদের বংশে জন্মগ্রহণ করবেন এবং পৃথিবীকে ন্যায় ও শান্তির সুবর্ণযুগে প্রবেশ করাবেন।
তালমুদ এবং নবীগণের বাণীতে বলা হয়েছে—মাশিয়াখের পদধ্বনি শোনার পূর্বে দুনিয়া গভীরতম অন্ধকারে ডুববে। রাষ্ট্রসমূহ একে অপরের বিরুদ্ধে উঠবে, নৈতিকতা ভূলুণ্ঠিত হবে, সত্য লুপ্তপ্রায় হবে। যখন মানুষ বলবে, “আর আশা নেই,” তখনই মাশিয়াখের আগমন ঘটবে।
ইহুদি ঋষিগণ এই শেষ সংকটকে “গগ ও মগগের যুদ্ধ” নামে অভিহিত করেছেন—এক মহাযুদ্ধ, যা মানব ইতিহাসের সর্বোচ্চ পরীক্ষা। কিন্তু এই যুদ্ধের পরেই উদিত হবে শান্তির সূর্য; জেরুজালেম পৃথিবীর আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হবে এবং সমস্ত জাতি এক ঈশ্বরের পতাকাতলে সমবেত হবে।
দুই বিশ্বাসের মিলনবিন্দু ও পার্থক্য
অদ্ভুত মিল এই যে, দুই ধর্মই শেষযুগকে এক গভীর সংকট এবং তার পরে অভূতপূর্ব মুক্তির যুগ বলে দেখে। কিন্তু খ্রিস্টানের কাছে সেই মুক্তিদাতা ইতিমধ্যেই এসেছেন—তিনি যিশু মসীহ, যিনি ক্রুশে মৃত্যুবরণ করে পাপের মূল্য দিয়েছেন এবং পুনরুত্থানের মাধ্যমে মৃত্যুকে জয় করেছেন। তাই তাঁর দ্বিতীয় আগমন কেবল বিজয়ের ঘোষণা।
ইহুদি বিশ্বাসে এখনও মাশিয়াখ আসেননি। যিশুকে তারা একজন মহৎ শিক্ষক বা নবী বলে সম্মান করলেও মাশিয়াখ বলে স্বীকার করেন না। তাদের প্রতীক্ষা এখনও অব্যাহত—এক অজানা দিগন্তের দিকে চেয়ে।
উপসংহার
এই দুই প্রাচীন ধর্ম যেন দুটি প্রদীপ—একই অন্ধকারের বিরুদ্ধে জ্বলছে, কিন্তু তাদের আলো ভিন্ন পথ দেখায়। একদিকে খ্রিস্টানের প্রতীক্ষা যিশুর মহিমাময় প্রত্যাবর্তনের, অন্যদিকে ইহুদির অপেক্ষা মাশিয়াখের প্রথম পদার্পণের। দুই ধর্মই বিশ্বাস করে—ইতিহাসের শেষ পৃষ্ঠায় লেখা আছে মানবজাতির মুক্তির কাহিনী। কেবল তাদের কলম এবং কালি ভিন্ন।
পাদটীকা
১. মথি রচিত সু সমাচার, অধ্যায় ২৪ ও ২৫؛ মার্ক রচিত সু সমাচার, অধ্যায় ১৩; লূক রচিত সু সমাচার, অধ্যায় ২১।
২. ইশাইয়াহ, অধ্যায় ৪, পদ ২।
৩. মার্ক, অধ্যায় ১, পদ ১৪–১৫; মথি, অধ্যায় ৩, পদ ২ ও ৬।
৪. যোহন, প্রথম পত্র, অধ্যায় ২, পদ ১৮; থেসালোনিকীয়দের প্রথম পত্র, অধ্যায় ১, পদ ৭–৮।
৫.ঈশ্বর, বিশ্ব, মানব এবং মাশিয়াখ—ইহুদি শিক্ষায়, পৃ. ২৫৭।
৬. আদিপুস্তক, অধ্যায় ১৪।
৭.ইশাইয়াহ, অধ্যায় ৬০, পদ ২১; ইহেজকিয়েল, অধ্যায় ৩৮ ও ৩৯।
৮.পূর্ববর্তী সূত্র।
৯.নেওয়া হয়েছে: মোহাম্মদ জাওয়াদ আসগারী , ইসলামী কালাম বিষয়ক বিশেষায়িত জার্নাল, পৃ. ৮৮–৯৬, গ্রীষ্ম ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দ/ইরানি ক্যালেন্ডার, সংখ্যা ৬২ (সংক্ষেপ ও সম্পাদিত)।



