আকল থাকা সত্ত্বেও, আমরা কেন নবীদের প্রয়োজন বোধ করি?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: আজকের যুক্তিবাদী যুগে একটি প্রশ্ন প্রায়ই উচ্চারিত হয় — “যদি মানুষ আকল নিয়ে জন্মায়, তবে নবী ও ধর্মের দরকার কী?। প্রশ্নটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ হলেও এর অন্তরে লুকিয়ে আছে গভীর দার্শনিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক মাত্রা। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আমরা বুঝতে পারি, আকল ও নবুয়ত একে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।
আকলর সীমা ও নবুয়তের প্রয়োজন
“আকল” বলতে এখানে কেবল দৈনন্দিন যুক্তি বা জীবিকার চাতুর্য বোঝানো হয় না; বরং বোঝানো হয়েছে মানুষের গভীর অনুধাবনশক্তি, বিশ্লেষণক্ষমতা ও পথনির্দেশের ক্ষমতাকে — যা ধর্মীয় পরিভাষায় “অন্তর্নিহিত হুজ্জাত” নামে পরিচিত।
এই আকলই মানুষকে আল্লাহরচেতনার পথে চালিত করে। চিন্তাশীল মানুষ বুঝতে পারে, বিশ্বজগৎ কোনো কাকতালীয় সৃষ্টি নয় — বরং এক সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান স্রষ্টার পরিকল্পনা। আর যেহেতু সেই স্রষ্টা উদ্দেশ্যহীন কিছু সৃষ্টি করেন না, তাই মানবজীবনও পথহীন নয়। এখানেই বুদ্ধি ঘোষণা করে: মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য দরকার এক ঐশী দিকনির্দেশনা, এক আস্থাভাজন পথপ্রদর্শক — যিনি নবী।
নবীগণ: আকলের পরিপূর্ণতা
নবীরা আকলকে বন্ধ করে দেন না; বরং তাকে পরিপূর্ণতা দেন।
আকল মানুষকে বলে — “দিকনির্দেশনার প্রয়োজন আছে”; নবী সেই দিকনির্দেশনা এনে দেন। আকল গন্তব্য বোঝে, কিন্তু নবী পথ দেখান।
যেমন এক যাত্রিকের প্রয়োজন হয় তিনটি জিনিস: চলার উপকরণ, পথের জ্ঞান এবং একজন পথপ্রদর্শক — জীবনের যাত্রায়ও তাই। কেবল আকল যথেষ্ট নয়; আকল নিজেই সাক্ষ্য দেয় যে নবী, ধর্ম ও শরিয়াহ্ মানবজীবনের অপরিহার্য অংশ।
আকলর দুর্বলতা ও নবীদের ভূমিকা
যখন মানুষের আকল অহংকারে অন্ধ হয় বা বিভ্রান্তিতে পড়ে, তখন তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। এই কাজই করেন নবীগণ। তারা আধ্যাত্মিক চিকিৎসকের মতো— অজ্ঞতার রোগ সারান, হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করেন এবং ওহির আলোয় ঘুমন্ত আকলকে জাগিয়ে দেন। নবীরা আকলর বিকল্প নন, বরং তার ধারাবাহিকতা; ধর্ম কোনো অন্ধ আনুগত্য নয়, বরং আকলসিদ্ধ বাস্তবতার উত্তর।
কুরআনের আলোয় নবুয়তের তাৎপর্য
কুরআন বলে:
کَمَا أَرْسَلْنَا فِیکُمْ رَسُولًا مِّنکُمْ یَتْلُوا عَلَیْکُمْ آیاتِنَا وَیُزَکِّیکُمْ وَیُعَلِّمُکُمُ الْکِتَابَ وَالْحِکْمَةَ وَیُعَلِّمُکُم مَّا لَمْ تَکُونُوا تَعْلَمُونَ
যেমন আমি তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যিনি তোমাদের কাছে আমার আয়াত পাঠ করেন, তোমাদের পরিশুদ্ধ করেন, কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন এবং তোমাদের সেইসব বিষয় শেখান যা তোমরা জানতেই না।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৫১)
এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয় — নবী মানুষের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ও আত্মার পরিশুদ্ধকারী। সত্যিকারের যুক্তিবান মানুষ নিজেই উপলব্ধি করে — নবীগণ তার চিন্তার যাত্রার পরিণতি, শত্রু নয়। কারণ তারা সেই পথ দেখান, যা আকল চিনে কিন্তু একা চলতে পারে না। যে নবীকে মেনে চলে, সে আসলে আকলর আহ্বানেই সাড়া দেয়; আর যে নবীদের অস্বীকার করে, সে নিজের আকলর কণ্ঠই শুনতে পায়নি।



