আই আর জিসির প্রধান নকদীর হুঁশিয়ারি: প্রকৃত লক্ষ্য আমেরিকার বহিষ্কার ও সায়োনিস্ট শাসনের অবসান
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৪ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইসলামী বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডারের উপদেষ্টা সারদার মোহাম্মদ রেজা নকদী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধারাবাহিক সামরিক ব্যর্থতা আজ এমন এক ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করেছে, যা ইরান ও প্রতিরোধের শক্তিগুলোর জন্য আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি আরও বলেছেন, শত্রুরা বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাত সৃষ্টি করে ইরানের মনোযোগ ভিন্নদিকে সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু জাতির উচিত প্রকৃত লক্ষ্য থেকে কখনো বিচ্যুত না হওয়া। তাঁর ভাষায়, “আমাদের মূল উদ্দেশ্য একটিই—এই অঞ্চল থেকে আমেরিকার উপস্থিতি নির্মূল করা এবং সায়োনিস্ট শাসনের অবসান ঘটানো।
আধ্যাত্মিক পথের দুই শত্রু
তেহরানের শিল্প প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্যে সারদার নকদী বলেন, মানুষকে আল্লাহ সর্বোচ্চ পরিপূর্ণতার পথে যাত্রার জন্য সৃষ্টি করেছেন। তবে এই পথে দুটি বড় অন্তরায় রয়েছে—মানুষের নিজের নফস এবং শয়তান ও তাগুতের প্রভাব।
তিনি ইমাম খোমেনিকে (রহ.) অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ের মহান নায়ক হিসেবে অভিহিত করে বলেন, “ইমাম এমনভাবে নিজের নফসকে পরাস্ত করেছিলেন যে, ক্ষমতার চূড়ায় থেকেও তিনি বিনয় ও সাধারণতার প্রতীক হয়ে ছিলেন।
বিপ্লবের ধারাবাহিকতা ও উত্তরসূরির ভূমিকা
নকদী বলেন, ইমাম খোমেনির পর আল্লাহ ইরানকে এমন একজন যোগ্য নেতা দান করেছেন, যিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসলামী বিপ্লবকে কোনো বিচ্যুতি ছাড়াই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। “এটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং এই বিপ্লব তাঁর ইচ্ছাতেই টিকে আছে,”—বলেন তিনি।
ইমামের সময়োপযোগী পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নকদী উল্লেখ করেন, ইমাম খোমেনি সবসময় সময়োপযোগী পদক্ষেপের গুরুত্ব গভীরভাবে অনুধাবন করতেন। ক্যাপিটুলেশন আইনকে তিনি জাতীয় মর্যাদার পরিপন্থী এক কলঙ্ক হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, যা কোনো সম্মানিত ইরানি মেনে নিতে পারেনি। তাঁর আহ্বানেই জনগণ শাহ ও আমেরিকার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।
তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালে আমেরিকা যখন পতিত শাহকে আশ্রয় দেয়, তখন ইরানি শিক্ষার্থীরা সময়মতো পদক্ষেপ নিয়ে মার্কিন দূতাবাস দখল করে। “সেই পদক্ষেপ কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না; এটি জাতির আত্মসম্মান রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিল,”—যোগ করেন তিনি।
আমেরিকার পরাজয় ও অর্থনৈতিক পতন
নকদী বলেন, ১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত আমেরিকা ইরানের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। কিন্তু দূতাবাস দখলের পর থেকে ইরানি জাতি নিজ ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। এরপর থেকে আমেরিকা সরাসরি মুখোমুখি সংঘর্ষের সাহস পায়নি; বরং তারা ব্যবহার করেছে প্রক্সি যুদ্ধ, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, সাদ্দাম হোসেন এমনকি দায়েশ (داعش)—যারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। আজ তাদের শেষ অস্ত্র, সায়োনিস্ট শাসনও পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে,”—বলেন নকদী।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমেরিকার অর্থনীতি আজ গভীর সংকটে। দেশটি প্রায় ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণে জর্জরিত, প্রতি বছর তাতে আরও ৩ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, “আর কয়েক বছরের মধ্যেই আমেরিকার সব আয় কেবল ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে। এই দুর্বল আমেরিকাই আজ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অবিচল থাকার আহ্বান
বক্তৃতার শেষে সারদার নকদী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, “শত্রুদের ষড়যন্ত্র আমাদের মনোযোগ ভাঙতে পারে না। আমাদের লক্ষ্য স্পষ্ট—আমেরিকার বহিষ্কার এবং সায়োনিস্ট শাসনের অবসানই ইসলামী উম্মাহর বিজয়ের পথ।
আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা
নকদী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বোঝার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ভাষণগুলোর দিকেই তাকানো যথেষ্ট। “ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করেছেন যে, জনগণ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত—কারণ তিনিই সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামিয়ে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন, কয়েক মাস আগেও আমেরিকানরা সাহস করতেন না সপ্তাহান্তে পরিবার নিয়ে কোনো রেস্তোরাঁয় যেতে। সারদার নকদীর মতে, আমেরিকার এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি এবং অর্থনৈতিক মন্দা—সব মিলিয়ে এমন এক দুর্বল অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যা ইতিহাসে এক নতুন মোড় এনে দিয়েছে। এটি এমন এক সুযোগ, যা আল্লাহ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন,”—বলেন তিনি। “আজ আমাদের কর্তব্য হলো এই সুযোগকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানো।
অঞ্চল থেকে আমেরিকার বহিষ্কার ও সায়োনিস্ট শাসনের অবসান
তিনি সতর্ক করে বলেন, শত্রুরা নানা উপায়ে আমাদের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চায়। “তারা সুদানে রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে আমরা মূল ইস্যু থেকে দূরে সরে যাই। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই দিকভ্রান্ত হতে পারি না,”—বলেন নকদী। তাঁর মতে, প্রকৃত লক্ষ্য স্পষ্ট: “আমেরিকাকে এই অঞ্চল থেকে বিতাড়ন এবং সায়োনিস্ট শাসনের অবসানই আমাদের প্রধান মিশন।”
তিনি আরও বলেন,ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে সেই ভূমির প্রকৃত মালিকরাই—ফিলিস্তিনের জনগণ। বাইরের কোনো শক্তি তাদের ওপর শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে পারে না। ফিলিস্তিনকে অবশ্যই একক, ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে রূপ নিতে হবে, যেখানে শাসনব্যবস্থা নির্ধারিত হবে জনগণের ভোটে।
বৈশ্বিক জাগরণ ও ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ
নকদী বর্তমান সময়কে “মানব ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ” হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বের নিপীড়িত জনগণ আজ জেগে উঠছে।
“এটি এমন এক মুহূর্ত, যা হারানো চলবে না। আমাদের প্রত্যেকের উচিত ঐক্য ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সুযোগকে বাস্তব পরিবর্তনের পথে রূপ দেওয়া,”—বলেন তিনি।
তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার (আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী) গত বছরের ১২ আাবান তারিখের বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেন, “রাহবার তখন শিক্ষার্থী ও ছাত্রছাত্রীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, বিশ্বের যুব সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে এবং ইসলামী বিপ্লবের বার্তা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে। আজ আমাদের প্রধান দায়িত্ব সেই দিকেই মনোনিবেশ করা—আমরা যেন গৌণ ইস্যুগুলোর ভিড়ে ছড়িয়ে না পড়ি।
সামরিক শক্তির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান
সারদার নকদী দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের সামরিক শক্তির মূলভিত্তি হলো জাতির বৈজ্ঞানিক শক্তি। যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ের কৃতিত্ব হয়তো আমাদের, কিন্তু সেই বিজয় সম্ভব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষকদের হাত ধরে।
তিনি আরও বলেন,ইসরায়েলিরা যদি আমেরিকার সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা আত্মনির্ভর। আমাদের অস্ত্র ও প্রযুক্তি নিজেদের বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীরাই তৈরি করছে।
আত্মনির্ভরতা ও বর্তমান সামরিক সক্ষমতা
নকদী বলেন, আমরা একসময় এমন দেশ ছিলাম, যারা যুদ্ধের সময় এমনকি এক কিলোগ্রাম বিস্ফোরকও ১৩০ কিলোমিটার দূরে নিক্ষেপ করতে পারত না। কিন্তু আজ বৈজ্ঞানিক জাগরণের কল্যাণে সেই সীমাবদ্ধতা অতীত।
জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি—আজ ইরানের সামরিক বাহিনী শুধু অস্ত্র ও সরঞ্জামের সংখ্যায় নয়, যুদ্ধ-প্রস্তুতি ও মনোবলেও ২৩ খোরদাদের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী।



