অহংকারের বৃক্ষ—ইবলিস থেকে আমেরিকা পর্যন্ত ছায়া বিস্তার করেছে; তার শিকড় আজও জীবন্ত
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ি বলেছিলেন: অহংকারবিরোধী সংগ্রাম শুরু হয় মানুষের অন্তর থেকেই—সত্যের সামনে বিনয়, ন্যায়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ। এই চেতনা জীবিত থাকলে কোনো সমাজই বাহ্যিক শক্তিধরদের সামনে মাথা নত করবে না, আবার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও বৈষম্যের প্রতিও নীরব থাকবে না।
মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সত্য ও নবীদের বিপরীতে এক শক্তি দাঁড়িয়ে আছে—তার মূল ভিত্তি হলো আত্মঅহংকার। ইবলিস ছিল প্রথম সেই অহংকারী, যে বলেছিল: “আমি শ্রেষ্ঠ” এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিল। সেই মুহূর্ত থেকেই এক ধারার সূচনা হয়, যেখানে মানুষ বা কোনো ক্ষমতাশালী শক্তি নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচু মনে করে এবং সত্যকে পদদলিত করে। কুরআন এই মনোভাবকে “তাকব্বুর” ও “ইস্তেকবার” নামে অভিহিত করেছে, যা কুফর ও ফিতনার মূল উৎস। নবীদের দায়িত্ব ছিল মানুষকে এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আল্লাহর ইবাদতে ফিরিয়ে আনা; কারণ তাওহীদ কখনোই ইস্তেকবারকে অস্বীকার ছাড়া পূর্ণ হয় না।
ইতিহাস জুড়ে অহংকারীরা নানা রূপে আবির্ভূত হয়েছে—ফিরাউন ও নমরূদ থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বশক্তির নেতারা পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও ইমাম আলী (আ.) এই দম্ভী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং ন্যায় ও ঈমানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরবর্তীতেও যখনই দুর্বলরা প্রতিরোধে দাঁড়িয়েছে, শক্তিধররা তাদের বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়েছে। এভাবেই ইবলিসের সূচিত সেই রেখা অব্যাহত থেকেছে, যা প্রতিনিয়ত ক্ষমতালোভী ও জুলুমকারীদের মুখে প্রকাশ পায়।
ইসলামী বিপ্লবের নেতা ব্যাখ্যা করেছেন: প্রথম অহংকারী ছিল ইবলিস, যে আদমকে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিল এবং চিরকালীন অভিশাপে পতিত হয়েছিল। তিনি বলেন, ইস্তেকবার মানে আত্মঅহংকার, যার দুটি রূপ আছে—অভ্যন্তরীণ ও বৈরী। বৈরী ইস্তেকবারই হলো দমননীতি, লুটপাট ও আধিপত্য বিস্তার, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমেরিকা।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব এই সংগ্রামের আধুনিক প্রতিফলন। একটি জাতি “না পূর্ব, না পশ্চিম” শ্লোগান তুলে আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল এবং স্বাধীনতা ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছিল। এরপর থেকে শক্তিধররা নানা নিষেধাজ্ঞা, হুমকি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে এই প্রতিরোধ ভাঙতে চেয়েছে, কিন্তু অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—ঈমান ও দৃঢ়তার সামনে ইস্তেকবার শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়।
তবে ইস্তেকবার শুধু বাইরের নয়, ভেতর থেকেও সমাজে প্রবেশ করে। অহংকার, বিলাসিতা ও জনগণকে অবজ্ঞা করা হলো সেই অভ্যন্তরীণ ইস্তেকবারের রূপ, যা নিয়ন্ত্রণ না করলে বাইরের আধিপত্যের পথও প্রশস্ত হয়। যে সমাজে কিছু মানুষ নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাবতে শুরু করে, সেই সমাজ ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাইরের শত্রুর সামনে অসহায় হয়ে যায়।
তাই প্রকৃত ইস্তেকবারবিরোধিতা শুরু হয় মানুষের অন্তর থেকে—সত্যের সামনে বিনয়, ন্যায়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো এবং প্রতিটি জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। এই চেতনা জীবিত থাকলে সমাজ কখনোই বাহ্যিক শক্তিধরদের সামনে মাথা নত করবে না, আবার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও বৈষম্যের প্রতিও নীরব থাকবে না।
ইস্তেকবারবিরোধিতা কোনো সাময়িক নীতি নয়; এটি একটি স্থায়ী কৌশল, সভ্যতার দায়িত্ব এবং প্রতিটি মুক্ত মানুষের কর্তব্য। কুরআনের নির্দেশ “اجتنبوا الطاغوت”—অর্থাৎ অত্যাচারীদের থেকে দূরে থাকো—এই সংগ্রামের চিরন্তন ভিত্তি।
কুরআনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, শেষ পর্যন্ত পৃথিবী হবে সৎকর্মশীলদের অধিকারভুক্ত, অহংকারীদের নয়। সেই দিন পর্যন্ত প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব হলো এই পতাকা উঁচু রাখা—এক পতাকা, যা ইবলিসের অস্বীকৃত সিজদা থেকে শুরু হয়েছিল এবং আজ জাতিগুলোর প্রতিরোধে অব্যাহত আছে। আর যখন ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন, তখন পৃথিবী দেখবে ইস্তেকবারের সম্পূর্ণ পতন। জুলুম, বৈষম্য ও আত্মঅহংকারভিত্তিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, আর ন্যায় ও মানবিক মর্যাদা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
সেই সময়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর জাতি, ধন বা ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে না; বরং মূল্যায়নের মানদণ্ড হবে ঈমান, তাকওয়া ও মানবসেবায়। তখনই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে—“আমরা চাই পৃথিবীতে যারা দুর্বল, তাদের ওপর অনুগ্রহ করতে এবং তাদেরকে উত্তরাধিকারী বানাতে।
এভাবেই মানবজাতি ইস্তেকবারের ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে তাওহীদ ও ন্যায়ের আলোয় প্রবেশ করবে।



