ধর্ম ও বিশ্বাসজীবনযাপনবিশেষ সংবাদবিশ্ব

অধম প্রেমিক থেকে বিচ্ছেদের গোপন রহস্য

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইমাম আলী (আ.) আমাদের শিক্ষা দেন যে দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত প্রেম এবং ভৌতিক লোভই মানুষের সমস্ত বিপর্যয়ের মূল। যারা দুনিয়ার প্রতি লালসা ধরে রাখে, তারা ইতিহাসের ব্যর্থতার পাঠ না পড়ে সেই ভুল পুনরাবৃত্তি করে। অতএব, পূর্বপুরুষদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং এই অবিশ্বাসী প্রেমিককে (দুনিয়াকে) ত্যাগ করাই মুক্তির একমাত্র পথ।

কিছু রহস্য উন্মোচিত হয় যখন আমরা নিজেদেরকে ইতিহাসের হারানো স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেকর্ড হওয়ার আগে, সেই অতীতের মানুষের ভাগ্য দেখি—যারা আমাদের চেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ ছিল।

সাঈদ শিরী: ইমাম আলী (আ.)-এর সীরাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দুনিয়াবাদী না হওয়া এবং দুনিয়ার জন্য আকাঙ্ক্ষা পরিহার করা। নাহজুল-বালাগার বহু অংশই এই গুণাবলীর ব্যাখ্যা প্রদান করে। তিনি দুনিয়াকে লক্ষ্য হিসেবে দেখতেন না, বরং পার্থিব জীবনকে পরকালের জন্য একটি মাধ্যম মনে করতেন। তার আচরণ ও কথায় মানুষকে দুনিয়ার ঝলকানি থেকে সচেতন করা হতো।

এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল প্রকাশ খুঁজে পাওয়া যায় ইমাম সাদিক (আ.)-এর এক উক্তিতে:

«حبُّ الدنیا رأسُ کلِّ خطیئةٍ»
অর্থাৎ, দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ সব পাপের মূল।

এই অন্তর্দৃষ্টিতে, ইমাম আলী (আ.) নিজেই ছিলেন দুনিয়ার প্রতি উদাসীনতার নিখুঁত উদাহরণ। তিনি তপস্যার কারণে নয়, জ্ঞান ও বোধের কারণে দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে করতেন। দুনিয়াকে তিনি পরকালের খামার হিসেবে দেখতেন এবং হৃদয় রাখতেন সত্যের প্রতি, ধন-সম্পদ বা শোভা-সজ্জার প্রতি নয়। তিনি সৎ ও আল্লাহপ্রিয় মানুষের দলে ছিলেন, যারা দুনিয়াকে সত্যের জন্য ব্যবহার করতেন, নয়তো সত্যকে দুনিয়ার জন্য নয়।

তিনি গভীরভাবে বলেছিলেন:
«فَلْتَکُنِ الدُّنْیَا فِی أَعْیُنِکُمْ أَصْغَرَ مِنْ حُثَالَةِ الْقَرَظِ وَ قُرَاضَةِ الْجَلَمِ»

অর্থাৎ, দুনিয়ার সমস্ত ঝলকানি ও অলঙ্কারও যদি সত্য ও বৈধতার পথে না থাকে, তবে তা মৃত বা অমূল্য জিনিসের চেয়েও নগণ্য। তিনি এই চিত্রময় উক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, একজন ঈমানদার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এমন হতে হবে যে, দুনিয়ার বাহ্যিক সৌন্দর্যও আল্লাহর সত্যের সামনে কোনো প্রভাব রাখবে না। মানুষের প্রকৃত মূল্য পরিমাপ করা হয় তার ধর্ম, সততা ও দুনিয়ার ফাঁদে প্রতিরোধের ক্ষমতার দ্বারা, না কি ধন-সম্পদের দ্বারা।

ইতিহাসের সমস্ত মানবিক বিপর্যয়—সৃষ্টির সময় থেকে ইসলামীয় ইতিহাসের প্রথম যুগ, সাকিফাহর ঘটনা, আলাভংশের শাসনকাল, এবং কারবালার শোক—সবই মূলত দুনিয়ার লোভ, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা ও পার্থিব মর্যাদাকে আল্লাহর সত্যের উপরে রাখার ফল। যখন মানুষের মানদণ্ড দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী মানদণ্ডে পরিণত হয়, তখন পথ সত্যের থেকে ভ্রান্ত হয়।

অতএব, ইমাম আলী (আ.) বলেন:

وَ اتَّعِظُوا بِمَنْ کَانَ قَبْلَکُمْ قَبْلَ أَنْ یَتَّعِظَ بِکُمْ مَنْ بَعْدَکُمْ، وَ ارْفُضُوهَا ذَمِیمَةً فَإِنَّهَا قَدْ رَفَضَتْ مَنْ کَانَ أَشْغَفَ بِهَا مِنْکُمْ.

অর্থাৎ, পূর্বপুরুষদের থেকে শিক্ষা নাও, তার আগে যে তোমরা ভবিষ্যতের মানুষের জন্য শিক্ষা হবা। এই নিন্দিত দুনিয়াকে ত্যাগ করো, কারণ এর প্রতি তোমাদের চেয়ে বেশি আবেগপ্রবণদেরও এটি প্রত্যাখ্যান করেছে।

অতএব মুক্তির পথ হল,মানবজীবনের পথচলায় দুটি শিক্ষা যেন আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে—একটি অতীতের ছায়া থেকে, আরেকটি ভবিষ্যতের মুক্তির দিকে।

প্রথম শিক্ষা: ইতিহাসের পাঠ। যারা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয় না, তারা নিজেই একদিন সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়ে ওঠে। পূর্বপুরুষদের পতনের গল্প, জাতির ধ্বংসের ইতিহাস, সভ্যতার ভাঙনের ধ্বনি—সবই যেন সতর্কতার ঘণ্টাধ্বনি। ইতিহাস শুধু স্মরণ করার জন্য নয়, তা অনুসরণ করার জন্য; নয়তো মানুষ নিজেই ইতিহাসের করুণ অধ্যায় হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় শিক্ষা: দুনিয়ার প্রেম ত্যাগ। এটি কোনো নির্জীবতা বা সমাজবিচ্ছিন্নতার নাম নয়। বরং এটি হৃদয়ের গভীরতম আবেগকে এক অবিশ্বাসী প্রেমিকের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনার নাম। এই দুনিয়া, যতই মোহময় হোক, কখনোই তার প্রেমিকদের প্রতি সত্যনিষ্ঠ নয়। যারা এর মোহে আবদ্ধ, তারা একদিন বুঝতে পারে—এই প্রেম ছিল প্রতারণার, এই বন্ধন ছিল ক্ষতির।

এই দুই শিক্ষা—ইতিহাসের গভীরতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং দুনিয়ার প্রেম থেকে মুক্তি—মানুষকে নিয়ে যায় স্থায়ী কল্যাণের পথে। এ পথ কঠিন, কিন্তু মুক্তির একমাত্র সোপান।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button